ROOMS & SUITES
All 53 luxurious guest rooms, the fine teak wood-furnishing decoration. Feel the unique comfort in all feature the rigorous decorations and finest facilities to enhance your living experience.
খাগড়াছড়ি: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার

দেশের তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে খাগড়াছড়ি অন্যতম নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। এর পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পর্যটকদের হাতছানি। যোগাযোগ ব্যবস্থাও দারুণ। হাতে দুই/তিনদিনের সময় নিয়ে গেলে প্রকৃতির বেশ কিছু চোখ জুড়ানো রূপ দেখে আসা যাবে। আমার আজকের গল্পে পরিচিত ও অপিরিচিত কয়েকটি জায়গা তুলে ধরার চেষ্টা করব। তবে মূল জায়গা গুলো হবে এখনো অনেকের কাছে অচেনা অজানা কয়েকটি রোমাঞ্চকর ভ্রমণের কাহিনী নিয়ে। 

   ভ্রমণ পাগলুদের ঘুরে বেড়ানোর শখটাকে জগত সংসারের অনেকেই বিবিধ নেতিবাচক  ভাবনায় গলাটিপে ধরতে চায়। কিন্তু তারা হয়তো জানেন না, প্রজাপতির মত ঘুরে বেড়াতে প্রচুর টাকার প্রয়োজন হয় না।কিংবা নৈতিক চরিত্র অধঃপতনেরও তেমন সম্ভাবনা থাকে না। আলহামদুলিল্লাহ সেদিক হতে আমি ভাগ্যবান। তাইতো মাঝেমধ্যেই প্রাণের সংগঠন দে-ছুট ভ্রমণ সংঘর সঙ্গে দেশের নানান নয়নাভিরাম জায়গায় হুটহাট করেই ছুটে যাই। যেখানে এখনো সাধারণ ভ্রমণ পিপাসুদের পদচারণা তেমন নয়, সেসব জায়গাতেই দে-ছুট যেতে বেশি পছন্দ করে। তেমনি এবার লোক চক্ষুর আড়ালে থাকা বছর তিন আগে আবিষ্কৃত তাবাক্ষ গুহা হতে ঘুরে এলাম। তাবাক্ষ নামটার মাঝেই কেমন যেনো আদিমতা ভর করে আছে। 

 

 ভ্রমণ পরিকল্পনা সব ঠিকঠাক। কিন্তু যাব অচেনা-অজানা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল। তাই দীঘিনালার বাসিন্দা মি.রকি বিশ্বাসের সহযোগিতা নিলাম। তিনি গ্রীণ সিগনাল দিতেই এক বৃহস্পতিবার রাতের গাড়িতে ছুটলাম খাগড়াছড়ি। ভোরে নেমে প্রথমে হোটেলে সাফসুতর হয়ে, নাশতা সেরে আবারো উঠে বসলাম দাদার আমলের চান্দের গাড়িতে। প্রায় একঘন্টা চলার পরে মহাসড়ক ছেড়ে তাবাক্ষ গুহার দিকে, পাহাড়ি পথে কিছুটা অগ্রসর হতেই গাড়ি খাদে আটকে যায়। ঠেলা ধাক্কা নাকে দড়ি বেঁধেও গাড়ি আর চলমান কার্যক্রমে আনা গেলো না। খাদে আটকা অচল গাড়ি সচল করতে গিয়ে, ভ্রমণকালীন মহা মূল্যবান একটি ঘন্টার পুরোটাই বিফলে। অতঃপর দুই পা’ই ভরসা।  হাড়িপাতিলসহ বাজারসদাইর বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে ট্র্যাকিং শুরু। প্রখর রৌদ্র ওপেক্ষা করে হাইকিং ট্র্যাকিং চলছে। মাঝেমধ্যে ছায়াঘেরা কোন গাছতলায় জিরিয়ে নিই। চলতে চলতে চোখে ধরা দেয় শরতের নীল আকাশে পেঁজা তোলা শুভ্র মেঘের ভেলা। কখনোবা কালো মেঘের ঘনঘটা। ঢেউ খেলানো পাহাড়। জুমের ফসল। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ অরণ্য। উঁচু নিঁচু পাহাড়। নলখাগড়ার জঙ্গল। এসবই সামনে এগিয়ে যাবার প্রাণ শক্তি। এই শক্তি বেড়ে আরো দ্বিগুন হলো যখন একটা সময় পুরোপুরি জঙ্গলি পথে ঢুকে গেলাম। শরীরে সাপ প্যেঁচাবে নাকি কোন হিংস্র জন্তু পা কামড়ে ধরবে, সেদিকে কোন খেয়ালই ছিলো না। সে এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার স্যাপার। সব মিলিয়ে প্রায় তিন ঘন্টা হাইকিং-ট্র্যাকিং করতে করতে পৌঁছি বড় মাইরুং ঝর্ণার উপরে। গড়িয়ে যাওয়া টলটলে পানির ঝাপটা চোখেমুখে দিতেই সব ক্লান্তি উবে যায়। আহ্ কি শান্তি।

 

এবার জমবে আসল খেলা। দঁড়ি বেয়ে যখন সবাই তরতর করে ঝর্ণার পাদদেশে নামছিলো, তখন নয়া সঙ্গীদের অনেকেই আমাকে নিয়ে মজা লুটছিলো। তাদের ভাবনা আমাকে হয়তো ১১০ কেজির দেহটা নিয়ে ঝর্ণার উপরেই বসে থাকতে হবে। কিন্তু না। আমিতো দমে যাবার পাত্র নই। সহযোগিতায় এগিয়ে এলো গাইড মিলন ত্রিপুরা। সাহস যোগালো স্কাউট রেদওয়ান সহ ঘুরতে আসা স্থানীয় তরুণ দিপায়ন ত্রিপুরা। তাদের সহযোগিতায় তরতর করে প্রায় ৮৫ডিগ্রী খাড়া পাহাড়ের আনুমানিক ৪০/৫০ ফিট নীচে নেমে এলাম। এখানে রয়েছে বড় মাইরুং নামক একটি ঝর্ণা। এর শ্বেত শুভ্র হিমহিম ঠান্ডা পানি মন কেড়ে নেয়। বয়ে চলা ঝিরির পরিবেশটা দেখতেও বেশ নৈসর্গিক। ঝর্ণার পানি রিমঝিম ছন্দ তুলে অবিরাম গড়িয়ে পড়ে। এর শীতল পানি চুম্বুকের মত দেহটাকে টেনে নেয়ায় ইচ্ছেমত ভিজতে থাকি। সবুজের গালিচায় মোড়ানো গহিন পাহাড়ের বুক চিরে, জেগে থাকা বড় মাইরুং ঝর্ণার সৌন্দর্যও কম যায় না। 

 

ওদিকে দে-ছুট এর স্বেচ্ছ্বাসেবকদের কেউ কেউ জঙ্গল হতে লাকড়ি কুড়িয়ে আনে। কেউবা বড় বড় পাথর বসিয়ে চুলা বানায়। রন্ধন কারিগররা আগুন জ্বালিয়ে  রান্নায় ব্যতিব্যস্ত। বাঁশ কোড়ল সংগ্রহ করতে যাওয়া স্থানীয় বগড়াছড়া পাড়ার তরুণীরাও আমাদের রান্না যজ্ঞে হাত মিলায়। 

  অল্প কিছুদূর গেলেই কাংক্ষিত তাবাক্ষ গুহার দেখা মিলবে। কিন্তু না। এখনি যাচ্ছি না। আগে দুপুরের আহার সেরে নেয়া হবে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই রেডি হয়ে যায় সাদা ভাত আর মুরগীর তরকারী। আহ্ কি ঘ্রাণ! এই ঘ্রাণ কি তবে ঝর্ণার পানি দিয়ে রান্নার কারণে নাকি ভুবন ভুলানো প্রাকৃতিক নৈসর্গিক পরিবেশে বসে খাওয়ার জন্য। তা যাই হোক। সবাই মিলে পেট পুরে খাই। খেয়েদেয়ে এবার ছুটলাম তাবাক্ষ। 

অল্প কিছুদূর মাইরুং তৈসা ঝিরিপথ ধরে আগাতেই গুহামুখের দেখা মিলে। দেখেই কেমন কেমন যেনো রহস্যময় লাগে। ভিতরে ঢুকলে না জানি কি হয়। কিন্তু দে-ছুট এর দামালদের থামাবে কে। একে একে সবাই সরু গুহার ভিতর ঢুকে পড়ি। একটা সময় পুরোই ঘুটঘুটে অন্ধকার আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে। তবুও সঙ্গে নেয়া টর্চের আলোয় আগাতে থাকি। তাবাক্ষর ভিতরটা ভয়ঙ্কর অদ্ভুদ সৌন্দর্যে ঘেরা। পাথরের পাহাড়ের মাঝে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট তাবাক্ষ গুহা। টর্চের আলোয় উপরের দিকে তাকালে মনের মাঝে ভয়ানক শিহরণের দোল দেয়। তাবাক্ষর পাথুরে ছাদ জুড়ে যেনো রহস্য খেলা করে। গুহার কিছুকিছু জায়গা মাত্র ১৭/১৮ ইঞ্চি পাশ। সেসব জায়গা দিয়েও কাতচিৎ হয়ে অবলিলায় ঢুকে পড়েছি। দলের প্রত্যেকের মাথায় অদেখা কে দেখার নেশা চেপে ধরেছিলো। ভয় ডর সব তখন ছিলো ফিকে। কথা একটাই দেখতে হবে তাবাক্ষর শেষ অব্দি পর্যন্ত। গুহার আঁকাবাঁকা পথে আগাতে আগাতে একটা সময় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সরু পথের মাঝে থাকা এক খন্ড পাথর। হয়তো পাথরটি পথ আগলে না রাখলে আরো কিছুটা দূর যাওয়া যেতো। খানিকটা সময় পাথরের চিপাচাপা দিয়ে চোখ বুলিয়ে, সেখান থেকেই ফিরতি পথ ধরি। সাংবাদিক অপু দত্তর রিপোর্ট অনুযায়ী, তাবাক্ষ গুহা প্রায় ১৬০ ফিট দৈর্ঘ্য ও ৩০ ফিট উচ্চতা সম্পন্ন। প্রায় সাড়ে তিন ফিট প্রশস্তের হলেও,কয়েকাটা স্থানে একেবারেই সরু। স্থানীয়রা তাবাক্ষ গুহাটিকে দেবতার গুহা নামেও ডাকে। ত্রিপুরা ভাষায় তাবাক্ষ অর্থ বাদুড়ের গুহা। যারা যেই নামেই ডাকুক না কেন, এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। নিঃসন্দেহে ভ্রমণ পিপাসুদেরকে তাবাক্ষ গুহা রোমাঞ্চিত করবে এটা নিশ্চিত। তাবাক্ষ মিশন শেষ করার পরেও যাদের সময় থাকবে তারা ফেরার সময়ই যেতে পারেন তুয়ারী মারাইং।

 

গন্তব্য তুয়ারী মারাইং। গাইড মিল্টন ত্রিপুরার নির্দেশনা মতে ছুটলাম। পথে বিরতি দিয়ে পেটে কিছু দানাপানি ঢুকিয়ে নিই। সারাদিন কি পাব আর খাবো। তাই গরম গরম ভাত, ডিম, ভর্তা, ডাল দিয়েই সকালের নাশতা সেরে নিলাম। এরপর ছুটলাম পিচ ঢালা আঁকাবাঁকা পথে। যেতে যেতে নয় মাইল ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে মাহেন্দ্র ঢুকে যায় ইট সুরকির পথ মাইতুই পাড়ার দিকে। মনের ভেতর বেশ ভাললাগা কাজ করতে থাকে। চারপাশ সুনসান নিরবতা ভর করা অরণ্য ঘেরা সরু পথ। আলহাজ্ব মোস্তফা হাকিম বিদ্যা নিকেতন ছাড়িয়ে সীমানা পাড়ায় পৌঁছে গাড়ি ব্রেক। এবার শুরু ঢেউ খেলানো পাহাড়ে ট্র্যাকিং। মাথার উপর নীল আসমান জুড়ে শরৎ কালের শুভ্রতায় ছুটে চলছি। সঙ্গে জুমের ফসলের মন উদাস করা ঘ্রাণ। চলার পথে ছোট্ট একটি জুমঘরে খানিকটা সময় জিরিয়ে নেয়া। মাঝেমধ্যে দূর থেকে দৈত্বাকার গাছের ঘন অরণ্য দেখার মাঝে অদ্ভুদ অনুভূতি দোল দেয়। এরকমভাবে প্রায় ঘন্টাখানেক হাইকিং-ট্র্যাকিং করার পর,এক বিশাল খাদের কিনারায় গিয়ে থামতে হয়। এবার চিকন চিকন বাঁশের ফাঁক গলে নামতে হবে। দেখতে এসেছি -দেখতেই হবে। তাই লতা গুল্মের সাহায্যে নেমে যাই। নামলামতো ঠিকই। কিন্তু এর পরের দৃশ্য আরো ভয়ঙ্কর। অনবরত পানি গড়িয়ে যাচ্ছে। প্রায় দেড়শ ফিট উপর হতে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি পাথর আর পাথর। ঝুম বর্ষায় এটাও হয়তো একটা ঝর্ণার রুপ ধারণ করে থাকে। ঠিক ওই জায়গাটা দিয়েই ১০/১২ ফিট নীচে নামতে হবে। একটু এদিক সেদিক হলেই সাইজ। কি আর করা। দুর্বার দে-ছুট বলে কথা। সঙ্গীদের সাহায্যে রশি বেয়ে নেমে পড়ি। সেইরকম রোমাঞ্চকর অনুভূতি। লিখে বুঝানো মুশকিল। বুঝতে হলে যেতে হবে মায়াবি প্রকৃতির সান্নিধ্যে ঘেরা তুয়ারী মারাইং। প্রকৃতি যেমনি মায়াবি, ঠিক তেমনি আবার চরম প্রতিশোধ পরায়ন। যাক সেসব গুরুগম্ভীর কথা। বরং বাকি অংশের ট্রেইল নিয়ে গল্প করি।

 

তুয়ারী মারাইং ঝর্ণার দেখা পেতে আর খুব বেশি পথ ছিলো না। যতটুকুনই ছিলো শুধু পাথর আর পাথর। দুপাশে খাড়া উঁচু পাহাড়। ওর মাঝ দিয়েই চলছিলো আমাদের হাইকিং। প্রাচিন গাছগুলোর ডালপালা এমনভাবে একটা আরেকটার সঙ্গে জড়িয়েছিলো, যে কেউ প্রথম দেখায় ভূতুড়ে বাড়ির প্রান্তর মনে করে থাকবে। ভ্রমণান্দ ঠিক এই জায়গাটাতেই। যেতে যেতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঝর্ণার দেখা মিলে। সুবহানাল্লাহ। তুয়ারী মারাইং ঝর্ণার রূপ দেখবো নাকি এর পরিবেশের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখবো। কোনটা রেখে কোনটায় দৃষ্টি আটকাবো। পুরাই অস্থির প্রকৃতি। প্রায় শতফিট উচ্চতা থেকে ঝর্ণার পানিয় ধারা পতনের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। মন মাতানো অনবরত ছন্দতোলা রিমঝিম শব্দ। পানি পড়তে পড়তে ঝর্ণার সামনে খুব সুন্দর ক্যাসকেড তৈরী হয়েছে। যেখানে অবলীলায় সাঁতার কাটা যায়। ঝর্ণার ডান সাইডের পাহাড়ের পাদদেশটা চমৎকার আকৃতির। যেনো বিশাল একটি থালা। সম্ভবত এই কারণেই ঝর্ণার নামটা তুয়ারী মারাইং। তুয়ারী অর্থ কুয়া/কূপ আর মারাইং অর্থ থালা/বাসন। অর্থাৎ কুয়ার থালা। এটি একটি ত্রিপুরা ভাষার শব্দ। সব মিলিয়ে তুয়ারী মাইরাং ঝর্ণা ও এর পাহাড়ের পাদদেশের ভৌগলিক আকৃতি সহ এর যাবার ট্রেইলটা অসাধারণ সৌন্দর্য বহন করে আছে। যে কোন ভ্রমণ পিপাসু তুয়ারী মারাইং দেখতে গিয়ে,আমৃত্যু সুন্দর স্মৃতির ঝুলি নিয়ে ফিরতে পারবে। 

 

পরদিন ভোর প্রায় ৬ টায় হোটেলে বাড়তি কাপড়ের ব্যাগ রেখে বের হয়ে যাই পানছড়ি রোডের পেরাছড়ার পথে। সেখানে আগেই হাজির ছিলেন গাইড জগত জ্যোতি ত্রিপুরা। অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে জগতের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিই। এবার যাবার পালা মূল গন্তব্য মায়ুং কপাল। পুরোটা পথ হেঁটেই যেতে হবে। আসা-যাওয়া প্রায় ৫ ঘন্টার হাইকিং-ট্র্যাকিং। কিছুদূর যাবার পরেই চেঙ্গী নদী। ছোট্ট খেয়ায় পারাপার। নদীর গভীরতা তেমন না হলেও স্রোত ছিলো বেশ। চেঙ্গীর মাঝামাঝি দেহ অনুভব করে মৃদু বাতাসের শিহরণ। নদীর দুকূলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও বেশ নজর কাড়ে। পার্বত্য অঞ্চলের নদী গুলো এমনিতেই অন্যসব নদী গুলোর চাইতে ভিন্নরকম সৌন্দর্য বহন করে থাকে। 

 

      চেঙ্গী নদী পার হয়ে চ্যেলাছড়া পাহাড়ি গ্রামের ভিতর দিয়ে যেতে থাকি। যেতে যেতে চোখে পড়ে লক্ষী নারায়ণ মন্দিরের স্থাপনা। আরো কিছুটা দূর আগানোর পর বুনো পরিবেশ দিয়ে ঘেরা পথে উঠে যাই। এখন শুধু উপর দিকেই উঠছি। মাথার উপর আকাশ ছোঁয়া গাছের ছায়া। অচেনা পাখপাখালির সুর। বন্য ফুলের ঘ্রাণ। সুনসান নিরবতা সঙ্গী করে যেতে যেতে শঙ্খমোহন পাড়ায় থাকা বট বৃক্ষর ছায়াতলে জিরিয়ে নিই। ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী ত্রিপুরাদের বসবাসের পাড়াটা ছবির মত সুন্দর। বেশিরভাগ ঘরগুলো মাটি ও ছনের তৈরী। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নও বেশ। ইচ্ছে করেই কারো সঙ্গে তেমন আলাপ জমিয়ে তুলি নাই। কারণ আগেই তথ্য ছিলো এপাশটা যতদ্রুত পার হয়ে যাওয়া যায়। তাই মনের ভিতরও কাজ করছিলো সেই ছোট্ট বেলার নিত্যদিনের চোর-পুলিশ খেলার কাহিনী। এসব কারণেই বাড়তি সতর্কতা হিসেবে বরাবরের মত অন্যসব জায়গার মত এখানকার স্থানীয়দের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করিনি। 

 

        জিরানোর সময়টুকুর মধ্যেই গাইডের সংগ্রহ করা টিপা ফল খেয়ে আবারো হাইকিং। এবার কিছুটা জঙ্গলি পথ মাড়িয়ে দূর থেকেই দেখা পাই কাংখিত মায়ুং কপাল পাহাড়ের। সুবহানাল্লাাহ। প্রথম দেখাতেই চোখ জুড়িয়ে যায়। চারিপাশে পাহাড় আর পাহাড়। সিঁড়ি বেয়ে উপর দিকে উঠতে থাকি। সিঁড়িটা এমনভাবেই খাড়া হয়ে উপর দিকে উঠছে যে,একটা সময় মনে হবে এই বুঝি নীল আসমানে ভেসে বেড়ানো শুভ্র মেঘ মালা ছুঁয়ে ফেলব। সেই সঙ্গে ডানে-বামে পাহাড়ের ঢেউ খেলানো দৃশ্যের অপার্থিব সৌন্দর্য। আসলে তখনকার অনুভূতিটা এখন লিখে বুঝানো দায়। অনুভব করতে হলে ছুটে যেতে হবে মায়ুং কপাল। গাইডের ভাষ্যমতে ৩১৫ সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে যাই মুয়ুং কপাল পাহাড়ের উপরে। ওহ আল্লাহ, এ যেনো আরেক জগত। পাহাড় থেকে পাহাড় দেখা। বর্ষা মওসুম হওয়ায় পাহাড় গুলো গাঢ়ো সবুজে মোড়ানো। গাছের পাতা গুলো ছিলো বৃষ্টি ভেজা চকচকে। দুচোখ যতদূর যায়,শুধু পাহাড় আর পাহাড়।আমরা আরো সামনের দিকে এগুতে চাই। কিন্তু গাইডের সবুজ সংকেত না থাকায়,সিঁড়ির কাছাকাছিই থাকি। ওখান থেকেই নয়ন ভরে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করি। 

 

        মূলত পাহাড়ে বসবাস করা ত্রিপুরা সহ মোট ১৫টি ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী জনগণের চলাচলের সুবিধার্থে ১৩জুন ২০১৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক সিঁড়িটি নির্মাণ করা হয়। যা এখন ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য অন্যতম দর্শনীয় স্থান। ত্রিপুরা ভাষায় হাতির মাথাকে মায়ুং কপাল বলা হয়। পাহাড়টির সামনের অংশ অনেকটা হাতির মাথার ন্যয় দেখতে। সেই কারণেই এর নাম মায়ুং কপাল। মোট ২৬৭ ধাপের সিঁড়িটির উচ্চতা প্রায় ৪০০ফিট। আর মায়ুং কপাল পাহাড়ের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ১২০৮ ফিট। সিঁড়িটি আনুমানিক প্রায় ১২০ ডিগ্রি এ্যঙ্গেলে খাড়া হয়ে উপর দিকে উঠেছে। যে কারণে অনেকেই স্বর্গের সিঁড়ি নামেও ডেকে থাকে। সবচাইতে মজার ব্যাপার মায়ুং কপাল সিঁড়ি বেয়ে উঠার মাঝামাঝি সময় যেরকমভাবে শরীরে বাতাস আছড়ে পড়ে শীতলতা আনে তা সিঁড়ির নীচে-উপরে ওরকমটা পাওয়া যায় না। মায়ুং কপাল পাহাড়ে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় কাটিয়ে, দিপা ত্রিপুরার বাগানের পাহাড়ি আম রাঙগুই’র স্বাদ নিয়ে ফিরতি পথ ধরি। 

 

 

 

সতর্কতাঃ অ্যাডভেঞ্চার ট্রাভেল করার উপযোগি রশি, শুকনো খাবার ও পর্যাপ্ত পানি সহ প্রয়োজনিয় ওষুধপত্র সঙ্গে নিবেন।

মায়ুং কপাল ভ্রমণের জন্য পেশাদার গাইড নেই। সুতরাং স্থানীয় যাকে নিবেন, বুঝেশুনে নিতে হবে। গাইডের পরামর্শ ছাড়া কোন পাড়া বা পাহাড়ের পথে আগাবেন না। 

 

 

যাবেন কিভাবেঃ ঢাকা হতে খাগড়াছড়ি রুটে বিভিন্ন পরিবহনের বাস সার্ভিস রয়েছে। বাসভেদে ভাড়া ৭৫০ টাকা থেকে ১৬০০ টাকা। তাবাক্ষ যেতে হলে খাগড়াছড়ি শহরের শাপলা চত্তর হতে চান্দের গাড়িতে ১৭ কিলোমিটার দূরত্বের দীঘিনালা উপজেলার আটমাইল নামক এলাকা হয়ে বড় পাড়া / বগড়াছড়া পাড়া পর্যন্ত যেতে হবে। এরপর প্রায় দুই কিলোমিটার পাহাড়ি পথে ট্র্যাকিং।

 

খাওয়া-থাকাঃ দিনে দিনে ঘুরে এসে শহরেই থাকতে হবে। তাবাক্ষ অবস্থানকালীন পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ও শুকনো খাবার সঙ্গে নিতে হবে। অবশ্যই স্থানীয় পাড়াগুলো হতে গাইড নিয়ে যেতে হবে। নতুবা পথ হারানো সম্ভাবনা রয়েছে। যারা খাগড়াছড়ি শহর হতে সরাসরি তুয়ারী মারাইং যেতে চান, তারা বাস স্ট্যান্ড হতে চান্দের গাড়ি/মাহেন্দ্র/সিএনজিতে দীঘিনালা নয় মাইল এলাকার সীমানা পাড়া পর্যন্ত যাবেন। মাইতুই বা সীমানা পাড়া হতে স্থানীয় গাইড পাওয়া যায়। মায়ুং কপাল যেতে শহর হতে অটো বা অন্য যে কোন বাহনে পানছড়ি রোডের প্যারাছড়া ব্রিক ফিল্ড। সেখান হতে চেঙ্গী নদী পার হয়ে ঘন্টা দুই হাইকিং-ট্র্যাকিং। তবে নদী পার হয়েই চ্যেলাছড়া পাড়ার কোন দোকানির সঙ্গে কথা বলে, স্থানীয় কাউকে নিয়ে নেয়াটাই ভাল হবে। এছড়া রয়েছে তৈদু ঝর্ণা,তোজেংমা, হাজাছড়া ও সিকাম তৈসা সহ আরো বেশ কিছু জায়গা। প্রিয় পাঠক এতোক্ষণত গেলো যারা অ্যাডভেঞ্জার পছন্দ করেন তাদের জন্য খাগড়াছড়ির খোঁজখবর। এবার যারা দেহের উপর চাপ না নিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে চান তারা দেখে আসতে পারেন আলুটিলা গুহা, রিসাং ঝর্ণা, চেঙ্গী নদীর তীর, হর্টি কালচার পার্ক, নিউজিল্যান্ড, পানছড়ির অরণ্য কুটির, সিন্দুকছড়ি ও রামগড় চা বাগান সহ খাগড়াছড়ি দিয়ে যেতে সহজ রাঙ্গামাটির সাজেক এবং সিজুক । সিকাম তৈসাও সাজেকের কংলাক পাহাড়ের পাদদেশে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হতে আরামপ্রিয় পর্যটকদের উদ্দশ্যে বলছি, গল্পের রোমঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার সম্পন্ন প্রতিটা দর্শনীয় জায়গা গুলো হতেই আপনার দৃঢ় মনোবল ও ভ্রমণবান্ধব মানসিকতা ঘুরে আসার জন্য সহায়ক হবে। তবে ভ্রমণ সঙ্গী অনুর্ধ্ব ১২ বছর ও বৃদ্ধ থাকলে সর্বসাধারণের জন্য পর্যটন স্পট গুলোতে যাওয়াটাই সুবিধা হবে। 

ভ্রমণ তথ্যঃ খাগড়াছড়ি এমন এক জেলা যেখানে ভ্রমণ পিপাসুরা সব মৌসুমেই ঘুরতে যেতে পারেন। এখানকার প্রকৃতি শীত, গ্রীষ্ম কিংবা শরৎ, হেমন্ত সব মৌসুমেই তার ভিন্ন ভিন্ন রূপের পসরা মেলে ধরে।

 

লেখক: সংগঠক, দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ 

 

ছবির ছৈয়ালঃ দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ